হাম রোগের লক্ষণ- হাম হলে করণীয়

হাম বা Rubeola একটি বায়ুবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ। হাম রোগের লক্ষণ প্রকাশের সাথে সাথে চিকিৎসা না করালে রোগীর নানা রকম জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। তাই হাম রোগ সম্পর্কে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। আজকের আর্টিকেলটিতে হাম কি? হাম কেন হয়? হাম হলে করণীয় ও চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত লিখছি। তাই হাম রোগ সম্পর্কে জানতে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন।
হাম কি?
হাম কি ? হাম সম্পর্কে অনেকে এই ধরনে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে থাকেন। হাম হল ভাইরাসজনিত ছোয়াঁচে রোগ। হাম রোগের ভাইরাসের নাম হচ্ছে Measles morbillivirus যার ফলে এই রোগটি হয়ে থাকে। কোন ব্যক্তি যদি হাম রোগে আক্রান্ত হয় তার হাচিঁ কাশির মাধ্যমে এর জীবাণু বাতাসের ছড়িয়ে পরে।
হাম রোগ প্রথমে শ্বাসনালিতে সংক্রমিত হয়ে থাকে। এরপর রক্তের মাধ্যমে সমস্ত দেহে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারনত এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ১০ থেকে ১৫ দিন পর এর উপসর্গগুলি প্রকাশ পেতে থাকে। তাই হামরোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে এর থেকে সতর্ক থাকতে হবে।
হাম রোগের প্রকারভেদ
সাধারনত এই ভাইরাসজনিত রোগটিতে শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। বিশেষ করে শীতকালের শেষের দিকে এবং বসন্তকালের শুরুতে এই রোগের প্রকোপ বাড়তে থাকে। ব্যক্তিভেদে হামরোগের উপসর্গ ভিন্ন হতে পারে। এই উপসর্গের উপর নির্ভর করে হাম রোগকে ভাগ করা হয়ে থাকে।
মানদেহে ৪ প্রকারের হাম রোগের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সেগুলি হচ্ছেঃ
১) মৃদু আকারের হাম।
(২) কৃষ্ণ বর্ণেও হাম।
(৩) রক্তস্রাবি হাম।
(৪) উদ্ভিদহীন হাম।
হাম রোগের লক্ষণ
হাম রোগের ভাইরাসটি জর্মান মিজলেস নামে পরিচিত। আমাদের অনেকে এই রোগকে সাধারন রোগ ভেবে অবহেলা করে থাকেন। এই রোগটিকে সাধারন রোগ মনে হলেও অবহেলার কারনে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এই রোগের কারনে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া ও অপুষ্টিজনিত নানা রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই হাম রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া মাত্রই এর সঠিক চিকিৎসার প্রয়োজন।
যদিও হাম রোগের জীবাণু মানবদেহে প্রবেশের কয়েক দিন পর এর উপসর্গগুলি প্রকাশিত হয়। তাই হাম রোগের উপসর্গ প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথেই এর চিকিৎসা করাতে হবে। চলুন তাহলে হাম রোগের উপসর্গ বা লক্ষণগুলি জেনে নেই।
১। হাম রোগের লক্ষণ সমূহের মধ্যে অন্যতম প্রধান লক্ষণ হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে জ্বর হবে।
২। শরীর ম্যাজম্যাজ করবে এবং শরীরে প্রচন্ড ব্যথ্যা অনুভব হবে।
৩। এই রোগের জীবানু মানবদেহে প্রবেশের পর ১ থেকে ২ দিন ধরে ১০২ থেকে ১০৩ ডিগ্রী জ্বর হবে।
৪। চোখ ফুলে যাবে, চোখ দীর্ঘ সময় ধরে লাল হয়ে যাওয়াসহ চোখ দিয়ে পানি পড়বে।
৫। নাক পানি পড় ও হাচিঁ আসা হাম রোগের অন্যতম উপসর্গ।
- আরও পড়ুনঃ টিবি রোগ কি? টিবি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
৬। অনেকের ক্ষেত্রে পাতলা পায়খানার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৭। হাম রোগটি অনেক কমপ্লিকেট হলে বমি ও নিউমোনিয়া হতে পারে।
৮। সর্বশেষ হাম রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায় তা হল শরীরে ফুসকুড়ি উঠা।
৯। প্রথমে ১ টা ২ টা ফুসকুড়ি দেখা দিলেও পরবর্তীতে সারা শরীর ছড়িয়ে পড়ে।
১০। শরীরের যে সর জায়গায় ফুসকুড়ি উঠে সেখানে চুলকাতে থাকে।
১১। শরীর প্রচন্ড জ্বালাপোড়া করে।
১২। আক্রান্ত ব্যক্তি কিছুই খেতে চায় না। এর ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
হাম রোগের কারণ
আপনাদের পূর্বেই বলেছি হাম ভাইরাসঘটিত তীব্র ছোয়াচেঁ রোগ। কোন ব্যক্তির দেহে হাম রোগের জীবানু প্রবেশ করলে তার থেকে আসে পাশের ব্যক্তি দেহে ছাড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাচিঁ কাশির মাধ্যমে একজন সুস্থ্য ব্যক্তির দেহে এই রোগের জীবানু প্রবেশ করে। কোন এক গবেষণায় দেখা গেছে, হাম রোগের ভাইরসা বাতাস ২ ঘন্টা বা এর চেয়ে বেশি সময় বেচে থাকতে পারে।
যেহেতু রোগটি অত্যন্ত ছোয়াচেঁ তাই বাতাস বা অক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ হাম রোগ ছাড়ানোর অন্যতম উপায়। হাম রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হচ্ছে এই রোগ সম্পর্কে সতর্ক হওয়া। আশে পাশের কেউ আক্রান্ত হলে তার থেকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকা।
হাম রোগের লক্ষণ

হাম হলে করণীয়
আমাদের অনেকে জানতে চান হাম হলে করণীয় কি? হাম হলে কি করতে হবে এই ধরনের প্রশ্ন অনেকে জিজ্ঞাসা করে থাকেন। হাম হলে ডাক্তার দেখিয়ে নিশ্চিত হতে হবে আপনি হামে আক্রান্ত কি না। অনেক সময় শরীরে ঘামাচি উঠতে যা দেখতে অনেকটা হাম রোগের ফুসকুড়ি মত। এছাড়াও শরীরে হাম হওয়ার পূর্বে হাম রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। এর মাধ্যমেও আপনি নিশ্চত হয়ে যাবেন।
হাম হলে রোগীকে প্রতিদিন গোসল করাতে হবে। গামছা বা পরিষ্কার কাপড় ভিজিয়ে সারা শরীর মুছে দিতে হবে। রোগীকে তরল জাতীয় খাবার দিতে হবে। রোগীকে ডাবের পানি, নরমাল পানি বেশি বেশি করে পান করতে হবে।এর ফলে শরীরের দুর্বলতা অনেকটাই কেটে যাবে। ডাবের পানিতে প্রাকৃতিক খনিজ উপাদান থাকে তাই ডাবের পানি পান করলে শরীরের খনিজ উপাদানের ঘাটতি পূরণ হবে।
হাম রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা
একবার কোন ব্যক্তি হাম রোগে আক্রান্ত হলে তা দূর সারানোর জন্য কোন ঔষধ নেই। হাম রোগ থেকে মুক্তি পেতে কিছু চিকিৎসা রয়েছে। ঘরোয়া চিকিৎসার মাধ্যমে ৩ থেকে ৪ দিনে মধ্যে সুস্থ্য হওয়া যায়। চলুন তাহলে হাম রোগের ঘরোয়া চিকিৎসা সম্পর্কে জেনে নেই।
হাম রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে মেথি ভেজানো পানি ও কলমি শাক খাওয়ালে লাল ফুসকুড়ি বেরিয়ে আসে। এর ফলে হামের প্রকোপ থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া যায়। হাম রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে আধা লিটার পানিতে ১০ গ্রাম জোয়ান, ৫গ্রাম তুলসী মঞ্জরী, ৫গ্রাম কুড় ও ৫ গ্রাম মেথি ফুটিয়ে অর্ধেকেরও কম করতে হবে। এরপর ফুটানো পানি ছাকনি দিয়ে ছেকে পান করলে অনেক উপকার পাওয়া যায়।
হাম রোগের ঔষধ
হাম রোগ থেকে মুক্তি পেতে হোমিও ঔষধ ও বায়োকেমিক ঔষধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। নিচে কয়েকটি হাম রোগের ঔষধের নাম দেওয়া হলঃ
- Aconite Nap: হাম হওয়ার পূর্বে প্রবল জ্বর, শরীরের জ্বলাপোড়া থেকে মুক্তি পেতে এই ঔষধটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়াও খুশখুশে কাশি, ঘামবিহীন জ্বর, ঘন ঘন পিপাসা ইত্যাদিতে Aconite Nap কার্যকরী উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে।
- Belladona: প্রচন্ড জ্বর, মুখমন্ডল লাল, মাঝে মাঝে অল্প ঘাম, ঘুম ঘুমভাব দূর করতে সাহায্য করে থাকে।
- Gelsemium: সর্দি জ্বর, নাক দিয়ে পানি পড়া, ঘন ঘন হাচিঁ, শুষ্ক কাশি ইত্যাদি প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে থাকে।
- Antim Tart: অনেক সময় হাম শরীর থেকে ভালভাবে বের হতে পারে না। এর ফলে শরীরে জ্বালা যন্ত্রণা হয়ে থাকে। এই ধরনের সমস্যায় এই ঔষধ অনেক কার্যকর।
হাম রোগের প্রতিকার
হাম রোগের প্রতিকার পেতে প্রতিষেধক হিসেবে ‘এমএমআর’ নামক হামের টিকা নেওয়া যেতে পারে। শরীরে এই ভ্যাকসিন দেওয়া থাকলে হাম হওয়ার আশাঙ্কা থাকে না। তাই ছোট বড় সকল বয়সের লোকের জন্য ভ্যাকসিন নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
- আরও পড়ুনঃ কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার
হাম রোগের লক্ষণ নিয়ে শেষকথাঃ
হাম বায়ুবাহিত ভাইরাসঘটিত ছোয়াচেঁ রোগ। এই রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। আশে পাশে কোন ব্যক্তি হামে অক্রান্ত হলে তার থেকে দূরের থাকতে হবে। যেহেতু শীতের শেষ ও বসন্তকালের শুরুর দিকে এই রোগের প্রকোপ বেড়ে যায় তখন একটু বেশি সচেতন হতে হবে। শরীরে হাম রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া মাত্রই নিকটস্থ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।