স্যাটেলাইট কি? স্যাটেলাইট কিভাবে কাজ করে বিস্তারিত তথ্য

সুপ্রিয় পাঠক/পাঠিকা! আজকের এই আর্টিকেলে স্যাটেলাইট কি, কত প্রকার, কিভাবে কাজ করে এবং এর সুবিধা অসুবিধা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলাম। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যুগে বিশ্বের সর্বশেষ খরব পেতে স্যাটেলাইট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়াও স্যাটেলাইট আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, ভূ-পৃষ্ঠ পর্যবেক্ষণ এবং মহাবিশ্ব সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে থাকে। তাহলে বুঝতেই পারছেন আজকের আর্টিকেলটি কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ। তাই স্যাটেলাইট সম্পর্কে সকল প্রকার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি ধৈর্য্যসহকারে পড়ুন…
স্যাটেলাইট কি
স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ ছাড়া আধুনিক পৃথিবীর কথা কল্পনা করা যায় না। সৃষ্টির আদিকাল থেকে বিশ্ব মন্ডলকে জানার আগ্রহ মানুষের মনে জন্ম দিয়েছে নানা কৌতুহল। এই কৌতুহল থেকেই মানুষ সৃষ্টি করেছে বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক যন্ত্র। মহাকাশ সম্পর্কে জানতে প্রেরণ করেছে মনুষ্যবিহীন ছোট ছোট যন্ত্র। এই সব ছোট ছোট যন্ত্র স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ নামে পরিচিত।
প্রশ্ন হলোঃ কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট কি? উত্তরঃ স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ হলো এমন একটি বস্তু যা ইচ্ছাকৃতভাবে একটি মহাকাশীয় বস্তুর চারপাশে কক্ষপথে স্থাপন করা হয়। যার মাধ্যমে যোগাযোগ রিলে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, নেভিগেশন, সম্প্রচার, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং পৃথিবী পর্যবেক্ষণ সহ ইত্যাদি কাজ করা হয়।
তাই পৃথিবীর চারদিকে হাজার হাজার স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয়েছে। এ সব স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও সেবা প্রদানে নিয়োজিত আছে। এছাড়াও জিপিএস বা Global Positioning System (GPS) এর কাজে স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
স্যাটেলাইট কে আবিষ্কার করেন
মহাকাশ সম্পর্কে জানার আগ্রহ অতি প্রাচীন কাল থেকে। সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে চন্দ্র, সূর্য ও তারকারাজি সম্পর্কে জানার অনেক আগ্রহ ছিল। তাই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তা জানার চেষ্টা করেছে। মনুষ্যহীন ছোট ছোট যন্ত্রের মাধ্যমে সেই সম্পর্কে জানতে পারছে। যা কৃত্রিম উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট নামে পরিচিত।
কিন্তু স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের আবিষ্কারের ইতিহাস খুব একটা পুরোনো নয়। মহাকাশে আধিপত্য বিস্তারের জন্য ১৯৫৭ সালের ৪ ই অক্টোবর ‘স্পুটনিক ১‘ নামে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাই বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ হচ্ছে ‘স্পুটনিক ১’।

রাশিয়ার rocket engineer and spacecraft designer, SERGEI KOROLEV নামক প্রোগ্রামার ‘স্পুটনিক ১‘ এর প্রাধান ডিজাইনার ছিলেন। এখন প্রশ্ন হলোঃ এই ‘স্পুটনিক ১’ স্যাটেলাইট কে আবিষ্কার করেন? উত্তর হচ্ছেঃ স্যাটেলাইট সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন, SERGEI KOROLEV । মজার ব্যাপার হচ্ছে, একই বছরের ২রা নভেম্বর স্পুটনিক-২ নামের রাশিয়া আরো একটি কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠায়।
পরবর্তী বছর যুক্তরাজ্য দ্বিতীয় দেশ হিসেব এক্সপ্লোরার-১ নামক স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করে। আস্তে আস্তে ফ্রান্স, জাপান, চীন, যুক্তরাজ্য, ভারত, ইসরাইল, ইউক্রেন, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং আফগানিস্তান স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করে।
বাংলাদেশও স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনে পিছিয়ে নেই। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন এর মধ্য দিয়ে ৫৭ তম দেশ হিসেবে মহাকাশ জয়ের দেশের গৌরব অর্জন করে। তবে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২’ উৎক্ষেপণ করার চেষ্টা করছে।
স্যাটেলাইট কাকে বলে
প্রশ্ন হচ্ছেঃ স্যাটেলাইট কাকে বলে? উত্তর হলোঃ ল্যাটিন শব্দ স্যাটেলেস থেকে স্যাটেলাইট শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে উপগ্রহ। স্যাটেলাইট হচ্ছে মানুষের তৈরি একটি যন্ত্র যা পৃথিবী থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে মহাকাশে উৎক্ষেপন করা হয় যার মাধ্যমে যোগাযোগ রিলে, আবহাওয়ার পূর্বাভাস, নেভিগেশন, সম্প্রচার, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং পৃথিবী পর্যবেক্ষণ সহ ইত্যাদি কাজ করা যায়।
স্যাটেলাইটের প্রকারভেদ
সূর্য, পৃথিবী বা অন্য কোন বিশাল বস্তুর চারপাশে প্রদক্ষিণ করা বস্তুকে উপগ্রহ বা স্যাটেলাইট বলা হয়। প্রধানত স্যাটেলাইটকে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম বা মানুষের তৈরি এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। চাঁদ হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ। অন্যদিকে, কৃত্রিম উপগ্রহকে কক্ষপথ এর উপর ভিত্তি করে তিনটি ভাগ করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে কৃত্রিম স্যাটেলাইটের প্রকারভেদ গুলি হচ্ছেঃ
১। Low earth orbit: এই ধরনে স্যাটেলাইট গুলি পৃথিবী পৃষ্ঠের তুলনামূলকভাবে কাছাকাছি অবস্থান করে। সাধারণত পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ১৬০ থেকে ২০০০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থান করে। স্যাটেলাইটের সুবিধা হচ্ছে এদের তলগুলো খুব সহজেই কাত হতে পারে। পৃথিবীকে নিবিরভাবে পর্যবেক্ষণ করার জন্য এই ধরণের স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
এই কক্ষপথের সময়কাল, সাধারণত উচ্চতার উপর নির্ভর করে। তবে 90-120 মিনিটের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। যেহেতু এই স্যাটেলাইগুলির উচ্চতা অনেক কম, তাই এদের গতিবেগ (>25,000 কিমি/ঘন্টা) অনেক বেশি হয়ে থাকে।
হাবল স্পেস টেলিস্কোপ, আর্থ ইমেজিং, জরিপ, সামরিক পর্যবেক্ষণ এমনকি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন এই কক্ষপথে অবস্থিত।
২। Medium earth orbit: Low earth orbit এবং Geostationary earth orbit কক্ষপথের মধ্যবর্তী অঞ্চলকে Medium Earth Orbit (MEO) বলা হয়ে থাকে। সাধারণত এই কক্ষপথটি পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে 2000 থেকে 35786 কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত।

MEO স্যাটেলাইটের কক্ষপথের সময়কাল 2 থেকে 24 ঘন্টার মধ্যে হয়ে থাকে। তাই এই কক্ষপথে স্যাটেলাইটের গতি কম। এই কক্ষপথে স্যাটেলাইট পাঠাতে অনেক শক্তির প্রয়োজন হয়। সাধারণত জিপিএস স্যাটেলাইট এই কক্ষপথে অবস্থান করে।
৩। Geostationary earth orbit: জিও স্টেশনারি স্যাটেলাগুলি পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ৩৬০০০ কি.মি. উচ্চতায় অবস্থান করে। এই অরবিটের স্যাটেলাইটগুলি পৃথিবীর ঘূর্ণন অনুসরণ করে পশ্চিম থেকে পূর্বে বিষুবরেখার উপরে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে।
জিও স্টেশনারি স্যাটেলাইটের কক্ষপথের সময়কাল 23 ঘন্টা 56 মিনিট এবং 4 সেকেন্ড যা প্রায় পৃথিবীর গতির সমান। তাই জিওতে অবস্থিত স্যাটেলাইটগুলিকে পৃথিবী থেকে ‘স্থির’ বলে মনে হয়। তবে পৃথিবীর ঘূর্ণের সাথে সম্পূর্ণ মিলে যাওয়ার জন্য, GEO স্যাটেলাইটের গত প্রতি সেকেন্ডে প্রায় 3 কিমি হওয়া উচিত।
এই স্যাটেলাইটের সুবিধা হচ্ছে টেলিকমিউনিকেশন, রেডিও এবং টিভি ইত্যাদি খুব সহজেই করা যায়। Meteosat, Intelsat, Insat ইত্যাদি জিও স্টেশনারি স্যাটেলাইটের অন্যতম উদাহরণ। এগুলি মূলত যোগাযোগ এবং আবহাওয়া পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়।
কাজের ভিত্তিতে স্যাটেলাইটকে বিভিন্ন প্রকারে ভাগ করা হয়ে থাকে। চলুন তাহলে কাজের ভিত্তিতে স্যাটেলাইটের প্রকারভেদ গুলি সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাকঃ
১। আবহাওয়া স্যাটেলাইটঃ
আবহাওয়া স্যাটেলাট হচ্ছে এক ধরনের জিও স্টেশনারি স্যাটেলাইট। সাধারণত আবহাওয়া ও জলবায়ুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য এই ধরণের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করা হয়। আবহাওয়া স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কোন দিন বৃষ্টি আসবে, কোন দিন ঝড় হবে, সাইক্লোন ইত্যাদি সম্পর্কে পূর্বাবাস পাওয়া যয়।
২। কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটঃ
কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশ বিদেশের সাথে খুব সহজেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়েছে। টেলিফোন ও ডেটা স্যাটেলাইটের রিলে করে কমিউনিকেশ স্যাটেলাইটগুলি কাজ করে থাকে। এটি ব্যবহারের মাধ্যমে যোগাযোগ সেক্টরের খরচের পরিমাণও অনেকাংশে কমে গেছে। এছাড়াও এই স্যাটেলাইটের সুবিধা হচ্ছে খুব অল্প সময়ে লক্ষাধিক ব্যক্তিরকে বর্তা পাঠানো যায়।
৩। ব্রডকাস্ট স্যাটেলাইটঃ
বর্তমান সময়ে এক দেশে বসে অন্য দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বিভিন্ন অনুষ্ঠান, খরব, নাটক ও সিনেমা খুব সহজে উপভোগ করা যায়। এসবে মূলে রয়েছে ব্রডকাস্ট স্যাটেলাইট। এই স্যাটেলাইটগুলি বিভিন্ন দেশের টেলিভিশন চ্যানেলের সিগনলা ট্রান্সমিট করতে সাহয্য করে থাকে।
৪। বৈজ্ঞানিক স্যাটেলাইটঃ
বিজ্ঞানের অবদানে পৃথিবী আজ হাতের মুঠোয়। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ফলে মহাকাশ, মহাসমুদ্র কিংবা মাটির নিচের অনেক অজানা সম্পর্কে জানা সম্ভব হয়েছে। তেমনিভাবে বৈজ্ঞানিক গবেষণামূলক কাজে বিভিন্ন ধরনের স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ধরনের স্যাটেলাইটগুলির মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষতিকর রশ্মির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে।

৫। ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইটঃ
প্রিয় পাঠক, আপনারা হয়তো বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বড় বড় সমুদ্রযান দেখে থাকবেন। এই সমুদ্রযান কূল কিনারাবিহীন সমুদ্রে সঠিক পথে চলছে কিনা তা নির্ধারণ করতে এ ধরনের স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয়। যা সকলের কাছে ন্যাভিগেশন স্যাটেলাইট নামে পরিচিত। এছাড়াও এই ধরনের স্যাটেলাইটগুলি গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
৬।রেসকিউ স্যাটেলাটঃ
রেসকিউ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বন্যা বা প্রাকৃতিক দূর্যোগকবলিত মানুষের অবস্থান ডিটেক্ট করা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে সে সব জায়গায় ত্রান ও খাবার পানি সরবারহ করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অনেক সময় বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্ঘটানায় আহত ব্যক্তিদের উব্ধার করা হয়।
৭। বায়ো স্যাটেলাইটঃ
বায়ো স্যাটেলাইট জৈব বৈজ্ঞানিক গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সাধারণত বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার অগ্রতি পর্যবেক্ষণের জন্য এই স্যাটেলাইট ব্যবহার করে থাকে।
৮। কিলার স্যাটেলাইটঃ
অনেক সময় একটি স্যাটেলাইট অন্য একটি স্যাটেলাইট দ্বারা আক্রমন হতে পারে। সাধারণত এই ধরণের অপ্রিতিকর শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পেতে কিলার স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয়। এই স্যাটেলাটে মূলত বিস্ফোরক পদার্থ মজুত থাকে। যখন শ্ত্রুপক্ষের স্যাটেলাইট তাকে আক্রমন করে তখন তাকে ধ্বংস করে দেয়।
৯। পৃথিবী পর্যবেক্ষণ উপগ্রহঃ
দিন দিন পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসংখ্যার অতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে প্রতিনিয়ত পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এছাড়াও কোথা অতি বৃষ্টি, কোথাও অনাবৃষ্টির সৃষ্টি হচ্ছে। এসব কিছু সমগ্র পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে। আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তন, পৃথিবীর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার জন্য এই ধরণের স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয়।
১০। সামরিক উপগ্রহঃ
সামরিক উপগ্রহগুলোর প্রধান কাজ হচ্ছে দেশকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করা। এই ধরনের স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের সামরিক কর্মকান্ড, অনুসন্ধান, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়ে থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন জটিল ও সংবেদনশীল কাজ যেমনঃ নিউক্লিয়ার ফিউশন এবং ফিশন বিক্রিয়ার পর্যবেক্ষণ করার কাজে এই স্যাটেলাইটের ব্যবহার হয়ে থাকে।
স্যাটেলাইট কিভাবে কাজ করে
পূর্বে আমরা স্যাটেলাইটের বিভিন্ন প্রকারভেদ সম্পর্কে জেনেছি। স্যাটেলাইটকে বিভিন্ন প্রকারে বিভক্ত করা হলেও তারা প্রায় একই নীতি অনুসরণ করে কাজ করে। চলুন তাহলে স্যাটেলাইট কিভাবে কাজ করে জেনে নেওয়া যাক।
সাধারণত স্যাটেলাইট বিভিন্ন আকৃতির হয়ে থাকে। তবে প্রত্যেকটি স্যাটেলাইটের দুটি কমন অংশ হচ্ছে এন্টেনা ও সোলার প্যানেল বা পাওয়ার হাউস। অ্যান্টেনাগুলো স্যাটেলাইটের বিভিন্ন প্রয়োগের উপর ভিত্তি করে মনোপোল, ডিপোল হর্ন, প্রতিফলক, মাক্রোস্টিপ ইত্যাদি ধরণের হতে পারে। স্যাটেলাইটের শক্তির উৎস হিসেবে সৌর কোষ এবং ব্যাটারি ব্যাকাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সৌরকোষগুলি সূর্যালোক থেকে শক্তি নিয়ে ব্যাটারি জমা রাখে।
টিভি ও বেতার সংকেত প্রেরণ এবং আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি কাজের জন্য স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয়ে থাকে। একটি স্যাটেলাইট পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৬০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করে। তাহলে প্রশ্ন হলো এই স্যাটেলাইট কিভাবে কাজ? এটি মূলত একটি রেডিও সিগন্যাল এর মাধ্যমে কাজ করে থাকে। স্যাটেলাইটগুলো পৃথিবী থেকে ওয়ারলেস টাওয়ার এর মাধ্যমে সিগন্যাল গ্রহণ করে পরে তা বিবর্ধিত করে পুনরায় পৃথিবীতে প্রেরণ করে।

একটি কমিউনিকেশন বা যোগাযোগ স্যাটেলাইটের মধ্যে এক বা একাধিক ট্রান্সপন্ডার থাকে। ট্রান্সপন্ডারগুলো গ্রহণকৃত সিগন্যাল এর ফ্রিকুয়েন্সি চেঞ্জ করা, নয়েজ ক্যান্সেল করা ও সিগন্যালকে বির্বধিত করা ইত্যাদি কাজ করে থাকে। স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ সিগন্যাল গ্রহণ বা পাঠানোর জন্য দুটি ভিন্ন কম্পাঙ্কের তরঙ্গ ব্যবহার করে।
স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত সিগন্যালগুলো অনেক দুর্বল প্রকৃতির হয়ে থাকে। ডিস অ্যান্টেনা ব্যবহারের মাধ্যমে এই সিগন্যালকে কেন্দ্রীভূত করা হয়। এরপর রিসিভার দিয়ে তা গ্রহন করে প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করা হয়। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, একটি টেলিকমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কিভাবে কাজ করে।
স্যাটেলাইটের কাজ কি
আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম আবিষ্কার হচ্ছে স্যাটেলাইট। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে খুব সহজেই দেশ বিদেশের তথ্য আদান প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে। স্যাটেলাইট তথা কৃত্রিম উপগ্রহ পুরো পৃথিবীর যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজ করে দিয়েছে। বর্তমানে তথ্য আদান প্রদান ও টেলিকমিউনিকেশন ছাড়াও বিভিন্ন কাজে স্যাটেলাইটের ব্যবহার করা হচ্ছে। তাই দিন দিন স্যাটেলাইটের কাজসমূহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলুন তাহলে স্যাটেলাইটের কাজ কি কি জেনে নেই।
১। আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ করা
২। তথ্যের আদান-প্রদান করা
৩।টেলিভিশন ও রেডিও এর মাধ্যমে বিভিন্ন তথ্যের সম্প্রচার করা।
৪। বিমান ও সমুদ্রগামী জাহাজের সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান
৫। সামরিক কাজ বা পরমাণু অস্ত্রের যথাযথ পর্যবেক্ষণ করা
৬। রাডার নিয়ন্ত্রণ করা
৭। শত্রুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা
৮। নেভিগেশন সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করা
৯। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজ করা
১০। স্যাটেলাইট ভিত্তিক যুদ্ধ পরিচালনা করা
১১। বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা তথ্য যোগাযোগ করা
১২। জিপিএস সিস্টেম এ সহযোগিতা করা
১৩। স্যাটেলাইট ফোন কলে সহায্য করা
১৪। ব্রডকাস্ট বা টেলিকাস্টে সাহায্য করা
স্যাটেলাইটের সুবিধা
স্যাটেলাইট হলো প্রযুক্তির সর্বোচ্চ চূড়া। স্যাটেলাইট আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে অনেক সুন্দর করে দিয়েছে। স্যাটেলাইট ব্যবহার করে একসাথে অনেক মানুষের কাছে ডেটা ট্রান্সফার করা যায়। তাই স্যাটেলাইটের সুবিধা বলে শেষ করা যাবে না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল যেখানে ইন্টারনেট ও ব্যাংকিং সুবিধা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এছাড়াও স্যাটেলাইটের সুবাধে টেলিমেডিসিন, ইন্টারনেটভিত্তিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো সম্ভব হয়েছে।
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে যে কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলা এবং দূর্যোগ পরবর্তী ত্রান ও পূর্ণবাসনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের দূর্ঘটনা সম্পর্কে জানা ও তার প্রতিরোধ করা যায়। স্যাটেলাইট ব্যবহার করে জলবায়ুর পরিবর্তন, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি সম্পর্কে সচেতন হওয়া যায়। যে কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়া যায়।

স্যাটেলাটের অন্যতম সুবিধা হচ্ছে আবহাওয়ার পূর্বাস জেনে ফসল কাটা ও নতুন ফসল রোপন করা যায়। এর ফলে কৃষি খ্যাতে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবলের থেকে স্যাটেলাইটের ডেটা পাঠানোর স্পিড অনেক বেশি। এছাড়াও এর অন্যতম সুবিধা হচ্ছে এর মাধ্যমে একজনকে ডেটা পাঠালে যে খরচ লক্ষাধিক ব্যক্তি পাঠালেও একই খরচ হয়। এটি ব্যবহার করে জিপিএস সিস্টেমের মাধ্যমে যে কোন জায় খোঁজে বের করা।
স্যাটেলাইটের অসুবিধা
স্যাটেলাইটের সুবিধার পাশাপাশি অনেক অসুবিধা রয়েছে। সাধারণত একটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন করতে অনেক টাকার খরচ হয়। স্যাটেলাইট তৈরি করার জন্য দক্ষ ইঞ্জিনিয়ারের প্রয়োজন হয়। সাধাণত আবহাওয়ায় এটি সম্পূর্ণভাবে কাজ করলেও বৈরি পরিবেশে সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। স্যাটেলাইটের অন্যতম অসুবিধা হচ্ছে খরচের তুলানায় এর আয়ুষ্কাল অনেক কম।
স্যাটেলাইট সম্পর্কিত আরও কিছু প্রশ্ন
স্যাটেলাইট কি পৃথিবী থেকে দেখা যায়
স্যাটেলাইট মূলত দুই প্রকারে ভাগ করা হয়ে থাকে। ১) প্রাকৃতিক স্যাটেলাইট ও ২) কৃত্রিম স্যাটেলাইট। প্রাকৃতিক স্যাটেলাইটের অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে চাঁদ। চাঁদকে পৃথিবী থেকে দেখা যায়। কিন্তু অন্যান্য স্যাটেলাইট অর্থাৎ, কৃত্রিম উপগ্রহগুলিকে পৃথিবী থেকে দেখা যায় না।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ কবে উৎক্ষেপণ করা হয়
বাংলাদেশ ৫৭ তম দেশ হিসেবে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের গৌরব অর্জন করে। ২০১৮ সালের ১১ মে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ কৃত্রিম উপগ্রহটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের কাজ করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হলেও বাংলাদেশ থেকেই এর নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তাই গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় এর গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ এর মেয়াদকাল
‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১’ ২০১৮ সালের ১১ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। উৎক্ষেপণের সময় থেকে স্যাটেলাইটটির মেয়াদকাল ১৫ বছর নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে অনেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের ধারনা এর মেয়াদ তিন বছর বাড়িয়ে ১৮ বছর পর্যন্ত করা সম্ভব।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কোথায় থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়?
২০১৮ সালের ১১ মে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ১ কৃত্রিম উপগ্রহটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়।
স্যাটেলাইট কিভাবে ঘুরে
পৃথিবী ও অন্য একটি বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষ বল বল কাজ করে। অন্যদিকে ঘূর্ণায় বস্তু কনা যখন বৃত্তাকার পথে ঘুরতে থাকে তখন তাদের মধ্যে কেন্দ্রমুখী বল কাজ করে। এই মহাকর্ষ ও কেন্দ্রমুখী বল পরস্পর সমান থাকে। এর ফলে স্যাটেলাইট তার কক্ষপথ থেকে ছিটকে যায়। আর নিউটনের ১ম সূত্র অনুসারে, কোন বস্তুর উপর যদি বল প্রয়োগ করা না হয় তাহলে গতিশীল বস্তু চিরকাল সুষম গতিতে এবং স্থির বস্তু চিরকাল স্থির থাকবে। এভাবে স্যাটেলাইট পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে থাকে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ২ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের নাম কি?
বঙ্গবন্ধু-১ কৃত্রিম উপগ্রহটি ফ্রান্সের থ্যালিস অ্যালেনিয়া স্পেস কর্তৃক নকশা ও তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট – ২ কৃত্রিম উপগ্রহটি রাশিয়ার গ্লাভকসমসের সঙ্গে স্যাটেলাইট তৈরি ও উৎক্ষেপণ বিষয়ে সহযোগিতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।
কত সালে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ২ উৎক্ষেপণ করা হয়?
২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশের দ্বিতীয় কৃত্রিম উপগ্র ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২’ উৎক্ষেপণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ২ এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি একটি ভূস্থির যোগাযোগ ও সম্প্রচার উপগ্রহ। এই স্যাটেলাইটের প্রধান কাজ হবে আবহাওয়া, নজরদারি বা নিরাপত্তাসংক্রান্ত তথ্য দেওয়া।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কাজ কি?
বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলো মধ্যে স্যাটেলাইট সেবা নিশ্চিত করা এর প্রধান কাজ। এছাড়াও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেট সংযোগ পৌঁছে দেওয়া। এর ফলে টেলিমেডিসিন, ইন্টারনেটভিত্তিক শিক্ষার প্রসার ও ব্যাংকিং সেক্টরে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে।
শেষকথাঃ
প্রিয় পাঠক, আশা করি আমাদের এই ফিচার পোষ্টের মাধ্যমে স্যাটেলাইট কি, কত প্রকার, কিভাবে কাজ করে এবং এর সুবিধা অসুবিধা এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। স্যাটেলাইট তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে অনেক সাফল্যের দিকে পৌঁছে দিয়েছে। এছাড়াও স্যাটেলাইট শিক্ষা, কৃষি এবং চিকিৎসা খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। স্যাটেলাইট ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ পরিবেশ, আবহাওয়া ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ সম্পর্কে সচেতন হতে পারছে। যদিও স্যাটেলাইটের কিছু অসুবিধা লক্ষ্য করা যায় তারপরও দৈনন্দিন জীবনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। স্যাটেলাইট সম্পর্কে আপনার যদি কোন প্রশ্ন থাকে, তাহলে মন্তব্যের মাধ্যমে জানাবেন।