সেমিকন্ডাক্টর কাকে বলে? কত প্রকার, এর বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহার

আজকে আমরা আলোচনা করবো সেমিকন্ডাক্টর কাকে বলে? সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহীর বৈশিষ্ট্য ও ব্যবহার নিয়ে। আধুনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি। আর এই ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির প্রধান উপকরণ হচ্ছে সেমিকন্ডাক্টর ম্যাটেরিয়ালস।বর্তমান সময়ে প্রায় সকল ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে সেমিকন্ডাক্টরের ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই অনেকের মনে সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী কি তা জানার আগ্রহ জাগে। তাই এই সম্পর্কে জানাতে আজকের এই ফিচার পোষ্টের আয়োজন।
সেমিকন্ডাক্টর কাকে বলে
সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী শব্দটি পদার্থবিজ্ঞান কিংবা তড়িৎ প্রকৌশল শিক্ষার্থীর কাছে অতি পরিচিত শব্দ। কিন্তু আমরা যারা সাধারণ শিক্ষার্থী তাদের মনে প্রায় সময়ই প্রশ্ন জাগে সেমিকন্ডাক্টর কাকে বলে বা অর্ধপরিবাহী পদার্থ কি? চলুন তাহলে অর্ধপরিবাহী সেমিকন্ডাক্টর সম্পর্কে জেনে নেওয়া যায়।
পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের পদার্থ পাওয়া যায়। এর মধ্যে কোনটি তড়িৎ পরিবহনে সাহায্য করে, কোন তড়িৎ পরিবহনে বাধা প্রদান করে। আবার অনেক পদার্থ আছে যা এই ধরণের পদার্থের মাঝামাঝি অবস্থান করে। তাই তড়িৎ পরিবাহিতার ওপর পদার্থকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথাক্রমে পরিবাহী, অপরিবাহী এবং অর্ধপরিবাহী।
পরিবাহীঃ যে সকল পদার্থের ভেতর দিয়ে খুব সহজেই তড়িৎ পরিবহন করতে পারে তাকে পরিবাহী পদার্থ বলে। উদাহরণ হিসেবে বিভিন্ন ধাতব পদার্থ যেমন কপার, অ্যালুমিনিয়াম, আয়রন ইত্যাদি।
অপরিবাহীঃ যে সকল পদার্থের মধ্য দিয়ে কোন তড়িৎ পরিবহন করতে পারে না তাদেরকে অপরিবাহী পদার্থ বলে যেমন শুকনা প্লাস্টিক ইত্যাদি।

অর্ধপরিবাহী বা সেমিকন্ডাক্টরঃ সকল পদার্থের তড়িৎ পরিবহন করার ক্ষমতা পরিবাহী ও অপরিবাহীর পদার্থের মাঝামাঝি তাদেরকে সেমিকন্ডাক্টর বা অর্ধপরিবাহী পদার্থ বলে। সেমিকন্ডাক্টরের উদাহরণ হচ্ছে কার্বন, সিলিকন জার্মেনিয়াম অ্যান্টিমনি, আর্সেনিক, বোরন ইত্যাদি।
সেমিকন্ডাক্টর কত প্রকার
সেমিকন্ডাক্টর এর বিশুদ্ধতার উপর ভিত্তি করে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমনঃ বিশুদ্ধ সেমিকন্ডাক্টর (Intrinsic semiconductors)বা অর্ধপরিবাহী এবং ভেজাল মিশ্রিত সেমিকন্ডাক্টর (extrinsic semiconductors) বা অর্ধপরিবাহী।
সেমিকন্ডাক্টর পদার্থের তড়িৎ পরিবহন করার ক্ষমতা পরিবাহী পদার্থের চেয়ে অনেক কম থাকে। তাই সেমিকন্ডাক্টর পদার্থের তড়িৎ পরিবাহিতা বৃদ্ধির জন্য অপ্রদব্য বা ভেজাল মিশ্রিত করা হয়। বিশুদ্ধ অর্ধপরিবাহীর সাথে ত্রিযোজী বা পঞ্চযোজী মৌলের ভেজাল মেশানোর প্রক্রিয়াকে ডোপিং বলা হয়। ডোপিং করার ফলে অর্ধপরিবাহীর তড়িৎ পরিবাহিতা কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
ডোপিং বা ভেজাল মেশানোর উপর ভিত্তি করে সেমিকন্ডাক্টরকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে।
ক) p-type সেমিকন্ডাক্টর
খ) n-type সেমিকন্ডাক্টর
এখন আমরা P টাইপ এবং N টাইপ সেমিকন্ডাক্টর কাকে বলে জেনে নিব।
p-type সেমিকন্ডাক্টরঃ বিশুদ্ধ জার্মেনিয়াম বা সিলিকনের সঙ্গে ৩ যোজী মৌল গ্যালিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, বোরন ইত্যাদি অপদ্রব্য সামান্য পরিমাণে মেশালে p টাইপ সেমিকন্ডাক্টর তৈরি হয়। সিলিকন বা জার্মেনিয়ামের সাথে অ্যালুমিনিয়াম কিংবা বোরন সমযোজী বন্ধন তৈরি করে। সমযোজী বন্ধন গঠনের সময়, বোরনের তিনটি যোজনীর সাথে সিলিকনের তিনটি যোজনী বন্ধন গঠন করলে চতুর্থ যোজনীটি বন্ধন তৈরি করে না। সিলিকন ও বোরনের কেলাসে বোরনের ইলেকট্রনের ঘাটতি দেখা যায়। এর ফলে বোরন পরমাণুতে একটি হোলের সৃষ্টি হয়। এই হোলগুলো ইলেকট্রন গ্রহনের জন্য উদ্গ্রীব থাকে। তাই P টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে হোল মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

n-type সেমিকন্ডাক্টরঃ N টাইপ সেমিকন্ডাক্টর গঠনের সময়, বিশুদ্ধ জার্মেনিয়াম বা সিলিকনের সাথে ৫ যোজী মৌল ফসফরাস কিংবা এন্টিমনি ভেজাল হিসেবে মিশ্রিত করা হয়। এর ফলে সিলিকনের ৪ টি যোজন ইলেকট্রন এন্টিমনির সাথে সমযোজী বন্ধন গঠন করে। কিন্তু সমযোজী বন্ধন গঠনের সময় এন্টিমনির একটি ইলেকট্রন লন পেয়ার অবস্থায় থেকে যায়। এই ইলেকট্রনটি অর্ধপরিবাহীতে ক্যারিয়ার হিসেবে কাজ করে। তাই N টাইপ সেমিকন্ডাক্টরে ইলেকট্রন মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
সেমিকন্ডাক্টর এর বৈশিষ্ট্য
সেমিকন্ডাক্টর পদার্থের তড়িৎ পরিবহন করার ক্ষমতা অপরিবাহীর ও অপরবাহীর মাঝামাঝি অবস্থান থাকায় বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে। এর সাথে বিভিন্ন ধরনের অপদ্রব্য মেশালে পরিবাহী পদার্থের ন্যায় আচরণ করে। এসব ধর্মের জন্য সেমিকন্ডাক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। চলুন তাহলে সেমিকন্ডাক্ট এর বৈশিষ্ট্য গুলি জেনে নেওয়া যাক।
১। সেমিকন্ডাক্টর পরিবর্তনশীল পরিবাহিতা প্রদর্শন করে। এর সাথে ত্রিযোজী বা পঞ্চযোজী ধাতুর মিশ্রনে এর পরিবাহিতা বৃদ্ধি পায়।
২। দুইটি ভিন্ন ভিন্ন ধাতু দ্বার ডোপায়িত সেমিকন্ডাক্টরকে একত্রে করলে এদের মধ্যে হেটারোজাংশন তৈরি হয়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বিভিন্ন দামী দামী ইলেকট্রনিক্স তৈরি করা যায়।
৩। সেমিকন্ডাক্টরের রেজিস্ট্যান্স পরিবাহী থেকে বেশি কিন্তু অপরিবাহীর থেকে অনেক কম।
৪। তাপমাত্রা বৃদ্ধি করলে সেমিকন্ডাক্টরের তড়িৎ পরিবহন করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
৫। সেমিকন্ডাক্টর পদার্থে উচ্চ তাপবৈদ্যুতিক ফ্যাক্টর রয়েছে যা তাপীয় জেনারেটর তৈরিতে সাহায্য করে।
সেমিকন্ডাক্টর এর ব্যবহার
বর্তমান সময়ে সেমিকন্ডাক্টর পদার্থের ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেমিকন্ডাক্টর পদার্থের দামে কম ও সহজলভ্য হওয়ায় প্রায় ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। মোবাইল, ল্যাপটপ কিংবা জেনারটরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ তৈরিতে সেমিকন্ডাক্টরের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তাই সেমিকন্ডাক্টর এর ব্যবহার করা হয় এমন ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রাংশগুলি হচ্ছে।
১। ডায়োড
২। রেক্টিফার
৩। এপ্লিফায়ার
৪। ট্রানজিস্টর
৫। সোলার প্যানেল
৬। বিভিন্ন প্রসেসর
৭। সুইচ
৮। রেগুলেটর ইত্যাদি প্রস্তুতে

শেষ কথা,
আশা করি এই আর্টিকেলের মাধ্যমে সেমিকন্ডাক্টর কাকে বলে? এটি কত প্রকার ও কিকি এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে আপনার একটি ভালো ধারণা হয়েছে।বর্তমান সময়ে ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি প্রস্তুতে সেমিকন্ডারের গুরুত্ব অপরিসীম। অর্ধপরিবাহী পদার্থের সাথে অপদ্রব্য মেশালে এর পরিবাহিতা অনেক বৃদ্ধি পায়। তাই সেমিকন্ডাক্টরের মাধ্যমে প্রায় সকল ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ প্রস্তুর করা হয়।