চোখ উঠা রোগ কি? চোখ উঠা রোগের লক্ষণ , কারণ, প্রতিকার ও চিকিৎসা

চোখ উঠা রোগের লক্ষণ,
চোখ উঠা রোগ কী?

বর্তমান সময়ে চোখ উঠা রোগটি মারাত্মক রোগগুলোর মধ্যে একটি। মেডিকেলের ভাষায় এই রোগটিকে কনজাংটিভাইটিস বলা হয়ে থাকে। এই রোগটি চোখের বিশেষ একটি সংক্রমণ রোগ যার ফলে চোখে কতুর জমে, চোখ লাল হয়ে যায় এবং চোখ দিয়ে সবসময় পানি বের হতে থাকে। যেহেতু এই রোগটি চোখের কনজাংটিভা নামক আবরকে সংক্রমিত করে সেক্ষেত্রে রোগটির সূচনা লগ্নেই আমাদের সচেতন হতে হবে।
চোখ উঠা রোগের কারণ
আপনি যদি চোখ উঠা রোগের সঠিক চিকিৎসা করাতে চান তাহলে আপনাকে চোখ উঠার প্রধান কারণগুলো জানতে হবে। আজকাল ডাক্তাররা চোখ উঠার অনেকগুলো কারণ চিহ্নিত করে থাকেন। তবে বেশির ভাগ ডাক্তার প্রধান তিনটি কারণকে দায়ী করেছন । এই প্রধান তিনটি কারণগুলো হলোঃ
১। ভাইরাস
২। ব্যাকটেরিয়া
৩। এলার্জি
সাধারণত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণকে ইনফেক্টিক কনজাংটিভাইটিস বলা হয়ে থাকে। আবার যদি এলার্জির কারণে চোখ উঠে তাহলে তাকে এলার্জিক কনজাংটিভাইটিস বলে। এছাড়া অপরিচ্ছন্ন জীবনযাপন , নিয়মিত চোখের যত্ন না নেওয়া এবং সবসময় অপরিষ্কার থাকার কারণেও চোখ উঠতে পারে।
চোখ উঠার লক্ষণ
পূর্বের আলোচনায় আমরা জানতে পেরেছি চোখ উঠার কারন মূলত ব্যাকটেরিয়া , ভাইরাস এবং এলার্জি এই তিনটি কারণে হয়ে থাকে। আপনি যদি চোখ উঠার লক্ষণ দেখা দেয়ার সাথে সাথে চিকিৎসা নিতে পারেন তাহলে কষ্ট কিছুটা কমবে।আসুন চোখ উঠার লক্ষণগুলি জেনে নেই ।
ভাইরাসের কারণে চোখ উঠার লক্ষণঃ
যদি ভাইরাসের কারণে চোখ উঠে তাহলে নিচের লক্ষণগুলি দেখেই আপনি চিহ্নিত করতে পারবেন।
- চোখ উঠলে চোখ লাল হয়ে যাবে
- চোখ ফুলে যাবে
- অনবরত পানি পড়তে থাকবে
- অনেক সময় প্রচন্ড ব্যাথাও করতে পারে।
ব্যাকটেরিয়ার কারণে চোখ উঠার লক্ষণঃ
যদি ব্যাকটেরিয়ার কারণে চোখ উঠে তাহলে নিচের লক্ষণগুলি দেখেই আপনি চিহ্নিত করতে পারবেন।
- চোখ ব্যথা হবে
- চোখে ময়লা জমবে
- হলুদ বা সবুজ পুজ জমবে
এলার্জিক কারণে চোখ উঠার লক্ষণঃ
ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার কারন ছাড়াও আরও একটি উপায়ে আপনার চোখ উঠতে পারে । ময়লা কাপড় , পুরনো বইখাতা , ফুলের রেণু , ধুলাবালি ইত্যাদিতে যদি আপনার এলার্জি থাকে তাহলে এগুলোর কারনে আপনার চোখ উঠতে পারে। আবার যারা অতিমাত্রায় কম দামি কসমেটিক ব্যবহার করেন এবং সুইমিং পুলের ক্লোরিনযুক্ত পানিতে গোসল করেন তাদের চোখ উঠার সমস্যা দখা দিতে পারে।যদি এলার্জিক কারণে চোখ উঠে তাহলে নিচের লক্ষণগুলি দেখেই আপনি চিহ্নিত করতে পারবেন।
- চোখের সাদা অংশ গাঢ় লাল টকটকে হয়ে যাবে
- প্রথমে এক চোখে আক্রান্ত হয়ে থাকে এবং পরে অন্য চোখে তা ছড়িয়ে পড়ে
- চোখে চুলকানি জ্বালাপোড়া ও খচখচ করে
- চোখ দিয়ে পানি পড়ে
- চোখের পাতায় পিচুটি (কেতুর)জমতে পারে
- চোখের কর্নিয়া আক্রান্ত হলে অনেকে চোখে ঝাপসা দেখেন
চোখ উঠা রোগের চিকিৎসা
আপনার যদি উপরে আলোচিত যে কোন কারনে চোখ উঠে শুরুতেই ডাক্তারি ঔষধ নেয়ার প্রয়োজন নেই । আপনি কিছু ঘরোয়া প্রদ্ধতি অবলম্বন করে আপনার চোখ উঠার রোগটি সারাতে পারবেন। নিচে কয়েকটি ঘরোয়া ট্রিপস
দেয়া হলোঃ
- গরম পানি ও তুলা চোখ পরিষ্কার রাখতে হবে – চোখ উঠলে প্রথমেই সামন্য পরিমাণ তুলা কুসুম গরম পানিতে ভিজিয়ে চোখে জমা ময়লা পরিষ্কার করতে হবে। এই প্রদ্ধতিটি হচ্ছে চোখ উঠার সবচেয়ে কার্যকরী ঘরোয়া চিকিৎসা প্রদ্ধতি।এই প্রদ্ধতিতে আপনার চোখে কোন ময়লা জমতে পারবে না পাশাপাশি অন্যদের সংক্রমণ কম হবে। এভাবে চোখ পরিষ্কার রাখলে নতুন করে কোন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমণ হওয়ার হাত থেকে বাচঁবেন। আপনি প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠার পর থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্ব সময় পর্যন্ত এই প্রদ্ধতিতে চোখ পরিস্কার রাখতে পারেন।
- পরিষ্কার পানি ব্যবহার করতে হবে- চোখ উঠলে অপ্রয়োজনে চোখে বার বার পানি লাগাবেন না এতে হিতের বিপরীত হতে পারে। বেশি বেশি পানি লাগালে চোখ সব সময় ভিজা থাকবে এতে ভিতরে ঘা এর মত হয়ে জ্বালাপোড়া করতে পারে। তাই পানি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন । প্রয়োজনে কাপড় বা তুলা ভিজিয়ে চোখ পরিষ্কার করে নিতে পারেন ।
- পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন জায়গায় অবস্থান করতে হবে – চোখ যদি ভাইরাস অথবা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয় তাহলে ঘরের ভিতর পরিষ্কার জায়গাতে অবস্থান করতে হবে। কেননা অপরিষ্কার নোংরা জায়গা ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া বেশি সমস্যা করে।
- চোখে চাপ পড়ে এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকুন- চোখে চাপ তৈরি করে এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আমাদের মধ্যে অনেকে একটানা ফোন ,ল্যাপটপ বা পিসি ব্যবহার করে থাকে এতে চোখে ঝাপসা লাগবে ।চোখে সমস্যা দেখা দিলে মাঝে মাঝে বিরতি নিয়ে কাজ করা উচিত।
চোখ উঠা কি ছোঁয়াচে?
এই রোগটি মারাত্মক ছোঁয়াচে রোগ । কেউ যদি আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহার করা জিনিসপত্র যেমনঃ জামা কাপড় , বিছানা বালিশ এবং চশমা ব্যবহার করেন তাহলে এই রোগটি তার এই হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির আশেপাশে বেশিক্ষণ
সময় ধরে অবস্থান করলেও এই রোগটি হতে পারে । কেননা এই রোগের জীবানু বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়।
চোখ ওঠা থেকে মুক্তির উপায়
চোখ উঠার সঠিক কারনগুলি চিহ্নিত করতে পারলেই এ রোগ থেকে মুক্তি পেতে পারেন। সাধারণত ধুলাবালি , ময়লা , অপরিষ্কার পানি প্রবেশ করলে এই রোগটি হয়ে থাকে। তাই এই রোগ থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রথমেই ধুলাবালি , ময়লা , অপরিষ্কার পানি চোখে যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
এই রোগটি ছোঁয়াচে হওয়ার কারনে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে। এছাড়া প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে পরিষ্কার পানি দিয়ে চোখ ধুতে হবে।
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
সাধারণত এই রোগটির জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন পরে না । ঘরে বসে চিকিৎসা নিলেই সুস্থ হওয়া যায়। উপরে আমরা কিছু ঘরোয়া চিকিৎসা প্রদ্ধতি বিস্তারিত আলোচনা করেছি । আশা করি উপরের নিয়মগুলি সঠিকভাবে পানল করলে অল্প কয়েক দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে যাবেন । অনেক ক্ষেত্রে এই রোগের স্বাভাবিক লক্ষণ ছাড়াওঅন্য আরও লক্ষণ দেখা দিতে পারে । এই ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তা না হলে আরও মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। আপনাদের যদি কারও নিচের লক্ষণ দেখা দেয় তাহলে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
১। মাত্রারিক্ত চোখ লাল হয়ে গেলে
২। চোখে কেতুর বা পুজ আসা না কমলে
৩। চোখ অতিরিক্ত ফুলে গেলে
৪। চোখে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলে
৫। চোখ চুলকালে

শিশুদের ক্ষেত্রে এই রোগটি দেখা দেয়া মাত্রই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। কেননা শিশুরা তাদের সমস্যার কথা বলতে পারে না । সাধারণত সে সব শিশুর বয়স ২৮ দিনের কম তাদের জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
চোখ উঠার ঔষধ কি
আপনারা অনেকে জানতে চেয়েছেন চোখ উঠা রোগটির ঔষুধ কি । সাধারনত চোখে কি ঔষুধ ব্যবহার করবেন তা নির্ভর করবে কোন কারনে চোখ উঠেছে তার উপর ।উপরে আমরা এই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি চোখ মূলত তিনটি ভিন্ন ভিন্ন কারনে উঠে থাকে । তাই এদের ঔষুধও ভিন্ন ভিন্ন হবে।
যদি ভাইরাস বা এলার্জিক জনিত কারনে চোখ উঠে তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এন্টিহিস্টামিন , এন্টি এলার্জিক ঔষুধ নিবেন। এছাড়াও ডাক্তাররা সাধারণত কিছু চোখের ড্রপ বা মলম দিয়ে থাকেন। ভাইরাস বা এলার্জিক কারনে চোখ উঠলে সে সব জিনিসে আপনাদের এলার্জি সেগুলি থেকে দূরে থাকবেন। প্রধানত ধুলাবালি, ফুলের রেণু, সুইমিং
পুলের ক্লোরিনযুক্ত পানি এবং জিনিসে এলার্জি বেশি হয়ে থাকে । তাই এসব জিনিস থেকে এড়িয়ে চলা জরুরি ।
যদি ব্যাকটেরিয়ার কারণে চোখ উঠে তাহলে ডাক্তার নির্দেশনা অনুযায়ী অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল আই ড্রপ দিবেন। আর সবসময় চোখ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবেন ।চিকিৎসক আপনার চোখের কন্ডিশ্ন অনুযায়ী আই ড্রপের পাশাপাশি কিছু সাসপেনশন দিতে পারেন।
- বিশেষ সতর্কতাঃ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নিজে নিজে কোন ড্রপ ব্যবহার করা থেকে
বিরত থাকুন।
চোখ উঠার ঘরোয়া ট্রিটমেন্ট
উপরে আমারা চোখ উঠা রোগের চিকিৎসা নিয়ে বিস্তারিত জানানোর চেষ্টা করেছি ।এই অংশে চোখ উঠা রোগের কিছু ঘরোয়া ট্রিটমেন্ট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।চোখ উঠা রোগের ক্ষেত্রে অধিক সচেতনতাই পারে আপনাকে দ্রুত সুস্থ করে দিতে। এই রোগের লক্ষণ দেখা মাত্রই নিচের সতর্কতা গুলি মেনে চলুন।
- কসুম গরম পানিতে কাপড় বা তুলা ভিজিয়ে চোখ পরিস্কার করতে হবে।
- চোখ চুলকালে চোখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকুন।
- চোখে সরাসরি পানি দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
- গোসলের সময় চোখে যাতে সাবানের পানি না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
- সানগ্লাস বা কালোচশমা ব্যবহার করতে হবে।
- বিছনার চাদর , বালিশের কাভার পরিষ্কার করে রাখতে হবে।
- চোখের ড্রপ ওপেনর করার ২৮দিন পর্যন্ত ব্যবহার করতে হবে।
FAQ: চোখ উঠা নিয়ে দো’আ কি?
চোখ ওঠা রোগের দোয়াঃ (আরবি উচ্চারণ)
اَللَّهُمَّ اِنِّى اَعُوْذُبِكَ مِنْ شَرِّ سَمْعِىْ وَ شَرِّ بَصَرِىْ وَ شَرِّ لِسَانِىْ وَ شَرِّ قَلْبِىْ وَ شَرِّ مَنِيِّىْ
চোখ ওঠা রোগের দোয়াঃ( বাংলা উচ্চারণ)
”আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিন শাররি সাময়ি ওয়াসাররি বাসারি ওয়াসাররি লিসানি ওয়া সাররি ক্বালবি ওয়া সাররি মানিয়্যি”
বাংলা অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কানের অপকারিতা, চোখের অপকারিতা, মুখের অপকারিতা, অন্তরের অপকারিতা ও বীর্যের অপকারিতা থেকে মুক্তি কামনা করছি।
শেষকথাঃ
আজকের এই আর্টিকেলটিতে চোখ উঠা রোগ কী? চোখ উঠা রোগের লক্ষণ এবং চোখ উঠা রোগের চিকিৎসা নিয়ে বিস্তারিত জানোর চেষ্টা করেছি । আশা করি আপনি এই সম্পর্কে জেনে নিজে সতর্ক হয়ে পরিবার , বন্ধু বা আশেপাশের লোকজনদের জানাবেন ।